bd news ছয় দফা দাবি কি কি? 2023 / Six point movement 2023

ছয় দফা দাবি কি কি? 2023 / Six point movement 2023


 

ছয় দফা দাবি কি কি? six point movement in bangla


বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এ কর্মসূচির ভূমিকা বা গুরুত্ব : পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিমাতা সুলভ আচরণের কারণে অব্যাহত অর্থনৈতিক শোষণ, জাতিগত নিপীড়ন ও প্রশাসনিক বঞ্চনা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের পাক - ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভৌগোলিক দিক থেকে ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে নিরাপত্তা হীনতা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। শোষণ, বঞ্চনা এবং নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের আশায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উদ্বেল হয়ে উঠে। এ সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতার শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন।  six point movement paragraph 


ছয় দফা দাবি / কর্মসূচির প্রেক্ষাপট: ছয় দফা কর্মসূচি প্রণয়নের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি ছিল নিম্নরূপ: 

১। সামাজিক প্রেক্ষাপট: একই রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভাষা, শিল্প -সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, রীতিনীতি, পোশাক -পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ তথা, সামাজিক দিক দিয়ে ব্যাপক পার্থক্য ছিল। একমাত্র ধর্ম ছিল দুই অঞ্চলের মধ্যে সেতুবন্ধন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙ্গালীদের তাদের অধীনস্থ করে রাখার জন্য ভাষার উপর আঘাত হানে। এক ঘৃণ্য তৎপরতাকে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নস‍্যাৎ করে দেয় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তথা বাঙালিরা। এর ফলে ধর্মের পরিবর্তে ভাষার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের জাতীয়তা বোধ গড়ে ওঠে, যা তাদের মুক্তির জন্য অনুপ্রাণিত করে।  six point movement in short 


 ২। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ‍্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হলেও পরবর্তীতে এর নীতি পরিত্যাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি অগ্রাধিকার লাভ করে। ১৯৪৭ সালের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়। শাসনতন্ত্র অনুযায়ী, ১৯৫১ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও শাসকগোষ্ঠীর তাবেদার দলের ভরাডুবির আশঙ্কায় নির্বাচন দেয় না। অবশেষে পূর্ব পাকিস্তানির নেতৃবৃন্দের চাপের মুখে ১৯৫৪ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয় এবং যুক্তফ্রন্ট ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে অধিকার আদায়ের সচেষ্ট হয়। কিন্তু স্বার্থ বাদী পাকিস্তানি শাসক সামান্য অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দেয় এবং সামরিক শাসন জারের মাধ্যমে শোষণ করতে থাকে।  বাঙ্গালীদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও শোষণ ৬ দফার অন্যতম প্রেক্ষাপট। six point movement summary 


 ৩। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট: বাঙ্গালীদের অর্থনৈতিক শোষণই ছিল ছয় দফা কর্মসূচির মূল প্রেক্ষাপট। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখানো হয়। পাকিস্তানের বৈদেশিক আয়ের ৭০% অর্জিত হতো পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ দিয়ে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের রাজকোষে জমা দেয়া হয় ২৫%। উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের পাচার হতো। পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের মাত্র ২০% থেকে ৩৬% ব্যয় করা হতো। বাকি অর্থ সংখ্যা লঘিষ্ঠ পশ্চিম পাকিস্তানদের জন্য ব্যয় করা হত। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর এই বিমাতা সুলভ আচরণ ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি লাভের জন্যই ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। 


  ছয় দফা দাবি / কর্মসূচি: ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরের অনুষ্ঠিত বিরোধী দল গুলোর সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাচার দাবি বলে অভিহিত করেন। ছয় দফা কর্মসূচির দফা সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো- 

প্রথম দফা - শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি: ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের যুক্তরাষ্ট্রের পরিণত করতে হবে। প্রদেশ গুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির। আইন পরিষদ হবে সার্বভৌম। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোট কেন্দ্র ও প্রাদেশিক আইনসভা গুলো গঠিত হবে।


দ্বিতীয় দফা- কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা: যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের হাতে কেবল দুইটি ক্ষমতা ন‍্যস্ত থাকবে। যথা- দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি। অন্য সকল ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকার গুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।


 তৃতীয় দফা - মুদ্রা ও অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা: দেশের দুইটি অঞ্চলের জন্য দুটি পৃথক অথচ  অবাধ বিনিময় যোগ্য মুদ্রা থাকবে, তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার রোধে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক অঞ্চলে একটি করে রিজার্ভ ব্যাংক থাকতে হবে। 

চতুর্থ দফা- রাজস্ব,  কর ও শুল্কসংক্রান্ত ক্ষমতা: খাজনা, ট্যাক্স, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকার গুলোর হাতে থাকবে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার তার ব্যয় নির্বাহের জন্য আদায়কৃত অর্থের একটি নির্ধারিত অংশগ্রহণ করবে। 


পঞ্চম দফা - বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা: বৈদেশিক মুদ্রার উপর প্রাদেশিক সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং আলাদা হিসাব থাকবে। প্রাদেশিক সরকার বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্কে আলাপ - আলোচনা ও চুক্তি করতে পারবে। 


  ষষ্ঠ দফা- আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রের অঙ্গরাজ্য গুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন করার ক্ষমতা দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করতে হবে। 


বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয় দফার গুরুত্ব: বাঙালি জাতীয়তা বাদ বিকাশে ছয় দফা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। একে বাঙালি জাতির "মুক্তির সনদ "  বললেও অত‍্যুত্তিূ হবে না। 

১। বাঙালির জাতীয়তাবাদের পূর্ণতা লাভ: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে তা পূর্ণতা লাভ করে। ছয় দফা কর্মসূচির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই এদেশের জনগণ নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি সত্তাকে বিকশিত করা স্বপ্ন দেখে। 


২। জাতির অধিকার সনদ: ছয় দফা আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতির অধিকার সনদ। যেসব শর্তের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছিল তার একটিও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হওয়ায় ছয় দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বাঙালি জাতি অধিকার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 


৩। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক: ছয় দফা আন্দোলন বাংলার রাজনীতিতে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাঙ্গালীদের মনে জাগিয়ে তোলে। এ আন্দোলন ছিল বাংলার জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তাই এতে বাংলার জনগণের অংশগ্রহণ ও সমর্থন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। 

৪। জাতীয় চেতনা বোধের জাগরণ: বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনাবাদের চেতনার উন্মেষ ঘটানোর ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালিরা নিজেদের উন্নতি যাতে নিজেরাই সাধন করতে পারে সে লক্ষে ছয় দফা দাবি পেশ করা হয়। এ দাবি ছিল বাঙালির মুক্তি সনদ বা বাঙালি জাতীয়তা বাদ কে আরো জোরদার করে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় চেতনা বোধ জাগরিত হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। 


 ৫। বাঙালি জাতীয়তা বাদ সুদৃঢ়করণ: ছয় দফা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় হয় এবং ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সংগ্রামী ঐক্য আরো জোরদার হয়।  সুতরাং, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ়করণে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। 


৬। পরবর্তী আন্দোলনে উৎসাহ দান: ছয় দফা ভিত্তিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাংলার জনগণের জাতীয়তাবাদের বিকাশ কে ত্বরান্বিত করা লক্ষে ৬৯ এর গণ আন্দোলন, 70 এর নির্বাচন এবং সর্বশেষ একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।  জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয় দফা  ভিত্তিক এসব আন্দোলনের গুরুত্ব অংশে কম নয়।


৭। অধিকার প্রতিষ্ঠা: ছয় দফা ছিল বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির গ্যারান্টি। পাক শাসন গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও শোষণ,  রাজনৈতিক অবিচার এবং সামাজিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের সামনে আশীর্বাদ রূপে ছয় দফা কর্মসূচি গৃহীত হয় যা জাতীয়তাবাদ বিকাশের পথ উন্মুক্ত করেছে। 


৮। স্বাধীনতা আন্দোলন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ছয় দফা কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছয় দফা ছিল বাংলার জনগণের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ছয় দফার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও তীব্র দমন নীতির কারণে বাংলার জনগণের মনে অনাস্থার ভাব সৃষ্টি হয়। তাই ছয় দফা দাবির উপর ভিত্তি করে বাংলার বীর জনতা শাসকগোষ্ঠীর সকল ভয়-ভীতি ও ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। 


৯। জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ: ছয় দফার প্রেক্ষাপটেই বাংলার জনগণ তাদের জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটায় এবং স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষ হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। এ সংগ্রামের সাফল্যের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালির জাতীয়তাবাদ বাস্তব রূপ লাভ করে।


 উপরিক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রকাশ্য অভিব্যক্তি ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর তা ৬ দফার জাদু মন্ত্রে গতিপ্রাপ্ত হয়ে বাস্তব রূপ লাভ করেছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে। বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের কেউ কেউ ছয় দফা দাবি কে " বাংলার ম‍্যাগনাকার্টটা", আবার কেউ কেউ বাঙালি জাতির "মুক্তির সনদ" বলে অভিহিত করেছেন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url